ব্যাংকার থেকে বাংলাদেশের মহানায়ক
বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি ‘দেবদাস’। শ্রীকান্ত হয়ে রাজলক্ষ্মীর ভালোবাসা চেয়েছিলেন। দীপুর বাবা হয়ে সন্তানের সাথে বন্ধু হয়ে মিশেছেন। আবার টুনির বাবা হয়ে সন্তানকে শাসন করেছেন। রুপালী সৈকতের মোহনায় তিনি অভিনয়ের সীমানা পেরিয়েছেন।
গরুর গাড়ি নিয়ে সেই বিখ্যাত গান ‘যদি বউ সাজো গো’ থেকে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র গানে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। তিনি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন জগতের কিংবদন্তী অভিনেতা মহানায়ক বুলবুল আহমেদ।

১৯৪১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করা এই অভিনেতা ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল ও নটরডেম কলেজের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। ক্যারিয়ার শুরু করেন একজন ব্যাংকার হিসেবে। ইউবিএল ব্যাংক টিএসসি শাখার ম্যানেজার হিসেবে ১০ বছর চাকরি করেন।
ষাটের দশকের শেষে আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘বরফ গলা নদী’ নামক টিভি নাটকে অভিনয় করে মিডিয়া জগতে পা রাখেন। এরপর ইডিয়ট, মাল্যদান, মালঞ্চ-সহ বেশ কিছু টিভি নাটকে অভিনয় করেন। এর মধ্যে ইডিয়ট নাটকে অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসিত হন।

১৯৭৩ সালে ইউসুফ জহিরের ‘ইয়ে করে বিয়ে’ ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় নাম লেখান বুলবুল আহমেদ। ধীরে ধীরে তিনি আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রুপালী সৈকতে, মোহনা, মহানায়ক থেকে চাষী নজরুল ইসলামের দেবদাস, শুভদা, আব্দুল্লাহ আল মামুনের দুই জীবন, কাজী জহিরের বধূ বিদায়, আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি, মোরশেদুল ইসলামের দীপু নাম্বার টু-সহ বেশ সংখ্যক দর্শকনন্দিত ও প্রশংসিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেই অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমেদ। তাঁর ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করে দর্শকদের কাছে একজন বলিষ্ট অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পান। বিশেষ করে সীমানা পেরিয়ের ‘কালু’ চরিত্রটি তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা চরিত্র।

তবে তিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে। এতটাই খ্যাতি পান যে দর্শক, সমালোচকদের কাছ থেকে তিনি ‘বাংলার দেবদাস’ উপাধি অর্জন করেন। তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন।রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, আকর্ষণ, গরম হাওয়া, কত যে আপন চলচ্চিত্রগুলো তিনি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেন।
এর বাইরে তিনি ওয়াদা, মহানায়ক-সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন। সেই সময়ের অন্যতম সেরা স্মার্ট এই নায়ক বানিজ্যিক ধারার জনপ্রিয় ধারাকে কখনোই তিনি উচ্চ আসনে দেন নি, সব সময় মুল্য দিয়েছেন চরিত্র ও সিনেমাকে। শাবানা, ববিতা থেকে কবরী সবারই প্রিয় সহকর্মী ছিলেন।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি টিভি নাটকেও বেশ ব্যস্ত ছিলেন। বিটিভির জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রী’ নাটকে অভিনয় করে বেশ আলোচিত হন। ক্যারিয়ারের মধ্যগগনেও চলচ্চিত্রে তিনি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর নব্বই দশকের পর নিয়মিত পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে যান।
তাঁর অভিনীত শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র হলো মুস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘দুই নয়নের আলো’। তবে তাঁঁর অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র এনামুর করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’ এখনো আলোর মুখ দেখে নি। ব্যক্তিজীবনে তিনি টিভি অভিনেত্রী ডেইজি আহমেদকে বিয়ে করেন। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বড় মেয়ে ঐন্দ্রিলা আহমেদ টিভি জগতে বেশ পরিচিত মুখ। বাকি দু’জন হলেন মেয়ে তিলোত্তমা এবং ছেলে শুভ।

চলচ্চিত্রজীবনের অবদান স্বরুপ তিনি অভিনয় শিল্পী হিসেবে চারবার ও প্রযোজক হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেন। সেরা অভিনেতা হিসেবে সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), বধূ বিদায় (১৯৭৮), শেষ উত্তর (১৯৮০) এবং পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬), আর প্রযোজক হিসেবে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৮৭) এর জন্য এই পুরষ্কার অর্জন করেন।
দর্শকদের হৃদয়ে স্থান পাওয়া এই কিংবদন্তি ২০১০ সালের ১০ জুলাই মৃত্যুবরন করেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে,বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। খুবই হতাশাজনক যে, এই কিংবদন্তি অভিনেতা আজ পর্যন্ত একুশে পদক পাননি। ভালো থাকবেন দেবদাস, যেখানেই থাকুন চির অমর হয়ে আছেন আপনি দর্শকদের হৃদয়ে।