আসুন দক্ষ হই, ঢাকার চাপ কমাই
১.
– শুধু কাজ করে লাভ নেই। দক্ষ হতে হবে।
কথাটা অনেক আগের শোনা। ২০০৫ সালে যখন প্রথম চাকুরিতে জয়েন্ট করি তখন এক জার্মান ভদ্রলোক আমাদের ফ্যক্টরিতে মেশিন সেট আপ করতে এসেছিলেন। খুব বড় একটা মাল্টিন্যাশনাল গ্রুপের ডিরেক্টর। কাজের খাতিরেই উনি একদিন আমাদের ফ্যক্টরিতে সারাদিন ছিলেন। কাজ শেষে ঢাকা ফিরেছিলাম এক গাড়িতেই। সেই সময় ঘন্টা তিনেক জ্যামে বসে ছিলাম। আধ ঘন্টার রাস্তা পার হতে আমাদের সময় লেগেছিল সাড়ে চার ঘন্টা। শুধুমাত্র কাচপুর ব্রিজের উপরেই বসে ছিলাম এক ঘন্টা। সেই মূহুর্তেই তিনি কিছু কথা বলেন। তার কথার সারমর্মগুলো একটু বলি।
আমরা যখন মেট্রিক, ইন্টার কিংবা অন্যান্য পরীক্ষা দিতে যাই তখন আমাদের একটা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সেটা হতে পারে দুই ঘন্টা, হতে পারে তিন ঘন্টা কিংবা পরীক্ষার ধরণ অনুযায়ী আরো কম বেশী। এটা কেন করা হয়?
পরীক্ষায় যে প্রশ্ন দেওয়া থাকে অনেকেই সেটা নির্দিষ্ট সময়ের মাঝেই শেষ করতে পারে। অনেকের আবার কিছু সময় বেশী প্রয়োজন হয়।
যদি পরীক্ষার জন্য অফুরন্ত সময় দেওয়া হতো তাহলে সমস্যা কি হতো?
আসলে পরীক্ষার অর্থ শুধু আপনি কোন বিষয়টা পারেন সেটা যাচাই করা নয়, এর সাথে সাথে আপনি কত কম সময়ের মাঝে সঠিক ভাবে উত্তরটা দিতে পেরেছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
জীবনটাও একটা পরীক্ষার মতো। স্কুলের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের যেসব পরীক্ষা নেওয়া হয় তার মূল উদ্দেশ্য আসলে আমাদেরকে জীবনের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা। এখানেও আপনাকে শুধু কাজটা সম্পন্ন করলেই হবে না, বরং এর সাথে সাথে কতটা দ্রুত করতে পেরেছেন সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
উন্নত দেশের মানুষগুলো এই দিকটাতেই আমাদের চেয়ে এগিয়ে যায়।
২.
আমাদের দেশে ইদানিং কালের অনেক বড় একটা সমস্যা হচ্ছে যানজট। আমি চাকুরির কারণে ময়মনসিংহ থাকি, সেখান থেকে প্রতি বৃহঃস্পতিবার মাইক্রোতে করে বাসায় ফিরতে আমার সময় লাগে প্রায় ৪-৬ ঘন্টা। অথচ একই জায়গায় শনিবার সকাল বেলা যেতে আমার সময় লাগে মাত্র ১.৩০ ঘন্টা।
আমাদের সময় কিন্তু লিমিটেড, আপনি ইচ্ছে করলেই এক দিনে ২৪ ঘন্টা সময় থেকে এক মিনিটও বাড়াতে পারবেন না। যে কাজটা করতে পারি সেটা হচ্ছে সময় নষ্ট না করা। অথচ রাষ্ট্রীয় ভাবেই আমরা এত সময় নষ্ট করছি। কোন মানুষই নেই এগুলো দেখার।
জার্মান সেই ভদ্রলোকের ভাষায় তাদের সব মানুষ গ্রামে থাকে। শহরে কাজের জন্য আসে, কাজ সেরে আবার গ্রামে ফিরে যায়। এটা সম্ভব দুটো কারণে। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত, দ্রুতগতির ট্রেন তাদেরকে অল্পসময়েই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌছে দিতে সক্ষম। আমাদের দেশে যে রাস্তা অতিক্রম করতে আট ঘন্টা সময় লাগবে জার্মানিতে নাকি সেটা দুই ঘন্টাতেই পার হয়ে যাওয়া সম্ভব।
একজন মানুষ ঢাকা শহরে থাকতে চায় কেন? কারণ অকারণে ঢাকাতেই সব প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে দেওয়া হয়েছে। নৌ অধিদপ্তর হয়ে আছে বনানীতে, মৎস ভবন কাকরাইলে। অনেক গার্মেন্টস আছে ঢাকা শহরে অথচ এই গার্মেন্টস গুলো শেষ পর্যন্ত রপ্তানী করা হয় চিটাগাং হয়ে। গার্মেন্টস শিল্প গুলো কি চিটাগাং এর আশেপাশে হওয়াটাই ভালো ছিল না?
আমি যখন ১০ বছর আগে স্কয়ার টেক্সটাইলে চাকুরি নেই তখন এখানে চা খাবার মতো কোন ভালো দোকান ছিল না। আজকে লট্টো, রিচম্যান, ক্যাটস আই-এর মত কোম্পানি এখানে শো রুম খুলে বসে আছে। জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে।
ঢাকা এবং তার আশেপাশের কিছু এলাকা নিয়ে মোটামুটি ২.৫ কোটি মানুষের প্রেশার। প্রতিদিন ঢাকায় প্রায় ৭-৮ লাখ মানুষ আসা যাওয়া করে।
এই ঢাকা কিভাবে টিকে আছে সেটাই রহস্য।
উন্নতি করতে চাইলে ঢাকার উপর চাপ কমাতে হবে। প্রতিটি মানুষই জীবন যাত্রার মান উন্নত করতে চাইবে। সেটা তার দোষ নয়। যারা নীতিনির্ধারক তাদের কাজ হবে একজন মানুষ ঢাকা এসে যে সুবিধাটা পায় সেটা যেন গ্রামে বসেই পেতে পারে সেটা নিশ্চিত করা।
৩.
শুধু রিসোর্স দিয়ে কখনো উন্নতি করা যায় না। অল্প রিসোর্সকেও ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে উন্নতি করা সম্ভব। আর আমাদের সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে নীতিনির্ধারকেরা। ইদানিং কালের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে জলাবদ্ধতা। একসময় নাকি ঢাকা শহরের আশেপাশে প্রায় ১০০ টি খাল ছিল যেখান দিয়ে পানি বের হয়ে যেত। বর্তমানে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি ৫৭ টির মতো খাল ভরাট করে ফেলেছে। বাকি ৪৩ টির মাঝে মাত্র ১৭ টি খাল কার্যকর রয়েছে। ১০০ টি খালের কাজ যখন মাত্র ১৭ টি খাল দিয়ে করা হবে তখন পানির উৎপাত তো বাড়বেই। সামান্য বৃষ্টিতেই এখন যে পরিমাণ পানি জমে যায় ভবিষ্যতের জন্য সেটা আশঙ্কাজনক।
অথচ, দেশ নাকি উন্নতির জোয়াড়ে ভেসে যাচ্ছে। আসলে উন্নতির সঠিক সংজ্ঞাটাই সম্ভবত আমরা জানি না।
যদি সত্যিই নিজেদের উন্নতি করতে চান তাহলে দক্ষ হওয়া ছাড়া গতি নেই।
সেই জার্মান ভদ্রলোকের সাথে আমার আবার দেখা করার খুব ইচ্ছে। ২০০৫ সালে উনি যা দেখে গিয়েছেন সেটাতেই পাগল হবার মতো দশা ছিল। আর বর্তমান অবস্থা দেখলে মনে হয় পাবনার হাসপাতালে একটা বুকিং দিয়েই ফেলতেন।
এই অবস্থার মাঝেও যে আমরা বেচে আছি সেটাই বিস্ময়ের। তবে, আশা করি এই অবস্থার পরিবর্তন একসময় হবে – আমরা জাতিগত ভাবেই দক্ষ হবো!