নানা-নাতি: অবিস্মরণীয় নস্টালজিক এক জুটি!
– আমার বন্ধুরে শুভ নববর্ষ জানায় আয় আমার শরীরটা খারাপ
– ভুল কথা কইতে পারুম না।
– এইখানে ভুল কি পাইলি?
– তুমি ক্যামনে বুঝলা নতুন সালটা তোমার বন্ধুর জন্য শুভ না অশুভ?
বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র যারা নিয়মিত দর্শক – তাঁদের জন্য এমন সংলাপ মোটেও অপরিচিত নয়। হানিফ সংকেতের সঞ্চালনায় ‘নানা-নাতি’ পর্বটা নব্বই দশকে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল। এর কল্যানে ‘নানা’ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, লোকে তাঁর আসল নামটা ভুলতে বসেছিল।
রাস্তায় তাঁকে দেখলেই দেখলেই হল, কানফাঁটা চিৎকারে ডাকতো – ‘ও নানা, তোমার নাতি কই!’ তিনি হলেন অমল বোস। প্রকৃত নাম অমলেন্দু বিশ্বাস। মঞ্চ, টেলিভিশন, বেতার কিংবা বেতার বিজ্ঞাপনচিত্রসহ সর্বক্ষেত্রেই দীপ্ত পদচারণা ছিল তাঁর। সব কিছু ছাপিয়ে তিনি অবশ্য ‘নানা’ নামেই স্মরণীয় হয়ে আছেন। সমান জনপ্রিয় হয়েছিলেন নাতির চরিত্র করা মোহাম্মদ শওকত আলী তালুকদার।
ঢাকার রামপুরায় তিনি থাকতেন। অমল বোসের জন্ম হয় ১৯৩৩ সালে, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার চত্রুল গ্রামে নানা বাড়িতে। তাঁর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুরে। তবে, জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি ঢাকাতেই কাটিয়েছেন।
রুপালি পর্দায়তিনি ছিলেন হাসির রাজা, টেলিভিশনের পর্দায়-ও তাই। কখনো নানা, কখনো বাবা, কখনো বা ধুরন্ধর কোনো নেতিবাচক চরিত্র। পাঞ্জাবি-পায়জামা ছিল তাঁর খুবই প্রিয় পোশাক। সব সময় কাঁধে একটা ঝোলা থাকতো। এফডিসিতেও ছিলেন সকলের প্রিয় মুখ। কারো সাথে দেখা হলেই হাসিমুখে কুশল বিনিময় করতেন। শিল্পী সমিতির রুমে গিয়ে বসতেন।
তবে, এর সব এখন কেবলই স্মৃতি, মুছে যাওয়া অতীত। ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি না ফেরার দেশে পারি জমান। সেদিন সকালে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু, হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সফর বাতিল করে ভর্তি হন অ্যাপোলে হাসপাতালে। সেখান থেকে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁর।
মঞ্চে অভিনয় করতে করতে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শুরু করেছিলেন। মঞ্চে তাঁর শুরু হয় ১৯৬৩ সালে, ঢাকা ক্লাব থিয়েটার দিয়ে তিনি যাত্রা করেন। সিনেমায় আসেন ১৯৬৬ সালে। প্রথম ছবি ‘সন্ন্যাসী রাজা’। অভিনয় করেছেন শতাধিক ছবিতে।
অমল বোস অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি হলো – আজকের প্রতিবাদ, অনন্ত ভালোবাসা, গরীব কেন কাঁদে, আমি তোসারি, সন্তান যখন শত্রু, লঙ্কাকাণ্ড, রক্তের অধিকার, কে অপরাধী, মুক্তি চাই, অধিকার চাই, বাপের টাকা, অচল পয়সা, আমার দেশ আমার প্রেম, মৃত্যু দাতা, সাগরিকা, জল্লাদ, রাঙা বউ, মধু, পূর্ণিমা, বেদের মেয়ে জোছনা, এরই নাম দোস্তী, বড় লোকের জামাই, এক টাকার বউ, তোমাকেই খুঁজছি, নীতিবান অফিসার, আক্কেল আলীর নির্বাচন, প্রিয়া আমার প্রিয়া, এরই নাম ভালোবাসা, কাল সকালে, হৃদয়ের বাঁশি, জোহরা, রাক্ষুসী ইত্যাদি।
মঞ্চ ও টিভি নাটকে তিনি মনে রাখার মতো অভিনয় করে গেছেন। সিনেমা পরিচালনার কাজও করেছেন। তাঁর পরিচালিত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে প্রথমেই থাকবে ‘কেন এমন হয়’। এ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৫ ডিসেম্বর। পেশাগত জীবনে জুট মিলস্ কর্পোরেশনের সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে চাকুরি থেকে অবসর নেন।
তিনি টানা ৩৮ বছর ‘অসুর’-এর চরিত্র করে যাওয়া বিরল এক রেকর্ডের অধিকারী। সার্বজনীন দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রচারিত বিশেষ নাটকে তিনি অসুর চরিত্রে অভিনয় করতেন। সম্প্রচারিত হত বিটিভিতে। এই চরিত্রটায় তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
অন্যদিকে, ‘নাতি’ নামে পরিচিত মানুষটি হলেন মোহাম্মদ শওকত আলী তালুকদার। নানা’র যেমন ইত্যাদির বাইরেও একটা আলাদা অভিনয়ে জগৎ ছিল, নাতির ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। তিনি এই গণ্ডী থেকে বের হতে পারেননি। ‘নানা’ পরপারে চলে যাওয়ার পর ‘নাতি’ চরিত্রটি অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। নাতি ক্রমশ হারিয়ে যান।
