ন্যুড || ছোট গল্প
আমার নাম ঈশিতা। বাবা মা আদর আদর করে ডাকেন ঈশি মনি। তিন ভাই বোনের সবচেয়ে বড় আমি। বাবা মায়ের আদর্শ বড় কন্যা আর ছোট দুই ভাই বোনের প্রচণ্ড ভালবাসার বপি। বড় আপির শর্ট ফর্ম আরকি।
স্টুডেন্ট হিসেবেও ছোটবেলা থেকেই আমি খুব ভালো ছিলাম। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তার হব, অবশ্য বছর দুয়েক আগ পর্যন্ত আমারও তাই ছিল।
তবে আমি এই দুই বছরে প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি, ডাক্তার হওয়া তো দুরের কথা, আমার আর কিছুই হওয়া হবে না । বাবা মা আর আমার কলেজের টিচার রা বুঝেছেন আজ, একটু আগে।
আজ আমার এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। অত্যন্ত পোর গ্রেড। টেনে টুনে পাশ বললেও ভুল হবে না । বাবা অনলাইনে আমার রেজাল্ট দেখার পর থেকে বাসার কারো সাথে কোন কথা বলছেন না। শরীর ছেড়ে দিয়ে নিজের বিছানায় পড়ে আছেন।
মা শুধু একবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছেন – এত খারাপ করলা ঈশিতা? তোমার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার । তোমার বাবার সব স্বপ্ন তুমি শেষ করে দিলা।
দীর্ঘ উনিশ বছরে এই প্রথম মা ঈশি মনি না ডাকে ঈশিতা ডেকেছেন। বোঝা যাচ্ছে শক এর পরিমাণ গুরুতর।
আমি মাথা নিচু করে মা কে বললাম – আমি তো খুব অসুস্থ ছিলাম মা। এগারো দিন হসপিটালেও ছিলাম। তুমি জানো না?
মা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। হয়ত আমাকে মনে করিয়ে দিতে গিয়েছিলেন দুই বছরে সাতশ দিনের বেশি সময়।
মা কে কি করে বোঝাই এই দুই বছর আমার কাছে সহস্র বছরের কম ছিল না।
বাবা মার সাথে আমার সম্পর্ক আহ্লাদ এর কিন্তু খুব সেনসিটিভ কিছু শেয়ার করার মত বন্ধুত্ব পূর্ণ নয়।
তবে আমি সত্যিই অসুস্থ ছিলাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য গত দুই বছরে আমি অনেক কঠিন কঠিন রোগ বাধিয়েছি। মাত্র উনিশ বছর বয়সে আমার সামান্য হাই ব্লাড প্রেশার আর সামান্য ডায়াবেটিসও ধরা পড়েছে। ইনসমনিয়ায় দুই চোখের নিচে তিন হাত করে কালি পড়েছে । প্রিটেস্ট পরীক্ষার পর পর একবার সিভিয়ার অসুস্থ হয়ে হস্পিটালাইজড ও ছিলাম এগারো দিন।
বাবা মা বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সবাই খুব অবাক হয়েছিল, একটা সুস্থ সবল মেয়ের কি করে এত অসুখ হয় এত অল্প সময়ে?
কেউ বুঝত না শুধু আমিই বুঝতাম, সুখ শেষ হয়ে গেলেই মানুষের অসুখ হয়।
সুখ কি করে শেষ হল সেই ঘটনাটা বলি।
এসএসসি এক্সাম এর পরের ছুটি চলছিল তখন। ছোট ভাই বোনের স্কুল আর কোচিং থাকায় খুব বেশী বেড়ানোরও সুযোগ হয়নি কোথাও । দিন তিনেকের জন্যে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়া ছাড়া পুরো সময়টাই বাসায়। টাইম পাস বলতে অনলাইনে ফ্রেন্ডসদের সাথে গুট গুট করে গল্প করা,ম্যুভি দেখা আর মাঝে মাঝে গল্পের বই পড়া।
দিনের বেশীর ভাগ সময় বাবা মা আর ছোট ভাই বোন বাসায় থাকত না। বাবা অফিস আর মা ভাইবোনদেরকে নিয়ে কোচিং আর স্কুল। আমার অখণ্ড অবসর আর ইন্টারনেট ইউজের অসীম স্বাধীনতার মাঝে বাধা ছিল না কোন কিছুই ।সেই স্বাধীনতাটাই বোধয় আমার কাল হল।
ফেসবুকেই পরিচয় ছেলেটার সাথে। আমার বছর চারেকের বড়। বলেছিল একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে গ্র্যাজুয়েশন করছে। পরে অবশ্য বুঝেছি নাম ঠিকানা সবই মিথ্যা।
তার যে আইডিতে আমার সাথে তার কথা হত বা বলা যায় প্রেম হয়েছিল সেটা আর নাই। গত দুই বছরে সে আলাদা আলাদা আইডি থেকে আমাকে বেশ কয়েকবার মেসেজ দিয়েছে। আর আমি প্রতিবার ভয়ে তাকে ব্লক করেছি । লাস্ট মেসেজ পাঠিয়েছে মাস তিনেক আগে আমার নতুন খোলা ইন্সটাগ্রাম একাউন্টে।
লিখেছে – তুমি মাটির নিচে গেলে আমি সেখানেও পৌঁছে যাব।
তারপর আমি ইন্সটাও ডিলিট করে দিয়েছি।
ঘটনাটার শুরুটা ভীষণ সুন্দর ছিল। একটা হ্যান্ডসাম ছেলে আর একটা সুন্দরী কিশোরীর প্রেম যেমন হয় তেমন।
প্রথমে হাই হেলো তারপর একটু একটু করে অনেক কথা এবং এক সময় প্রেম। অন্তত আমি তাই ভেবেছিলাম। সে আমার জীবনের প্রথম প্রেম হতে পারত যদি সে একটা সাইকো না হত।
আমি ভীষণ শাই ধরনের একটা মেয়ে ,খুব প্রাইভেট। অ্যাডাল্ট কোন কিছুর প্রতি অনৈতিক অতি উৎসাহও আমার নেই। জানি না সে কি জাদু করেছিল আমাকে, নাকি শয়তানের প্ররোচনায় আমি তার ফাঁদে পা দিয়েছিলাম।
একদিন মেসেঞ্জারে কথা বলার সময় সে আমাকে বলল – তোমার একটা ছবি দাও না।
আমি উত্তর দিলাম – টাইমলাইন ভরা আমার ছবি , আর কত সেলফিই তো দেই তোমাকে। ভিডিও কলে কথা হয়। আবার কি ছবি দিব?
সে বলল – অন্যরকম ছবি।
– মানে ?
– মানে, একটা ন্যুড দাও।
আমি আতকে উঠে বললাম – ছি, কি বলছো এসব ?
আমি ভাবলাম সে রসিকতা করেছে।
কিন্তু না। ছবি দিতে অস্বীকৃতি জানানোতে সে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল । আমি মেসেজ দিলে দেখেও উত্তর দেয় না , কল দিলে রিসিভ করে না।
আমার ভীষণ মন খারাপ হল। আমি সত্যিই ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এভাবে ওর চুপ হয়ে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রথম প্রেম বলে কথা।
তাই একদিন মেসেজ পাঠালাম – আচ্ছা দিব
সে সাথে সাথে রিপ্লাই দিল – সত্যিই দিবা?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা ঠিক আছে এত টেনশনের কিছু নাই। তুমি তোমার ফেইস বাদ দিয়ে ছবি দাও। তাহলে তো কোন সমস্যা নাই। তাই না ?
আমি ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেলেও বললাম
– না, সমস্যা নাই ।
তারপর আর কি? জীবনে যা কখনো ভাবি নি, যা আমার বড় হওয়া আমার স্বভাব, সংস্কার কোন কিছুর সাথে যায় না, আমি তাই করলাম। ছবি পাঠালাম তাকে। ন্যুড ছবি ।
যে আমি একা ঘরে কাপড় বদলানোর সময়ও লাইট অফ করে নেই । সেই আমিই বিবস্ত্র হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে পাঠালাম তাকে।
কিন্তু সেখানেই শেষ হল না। দুই দিন পর থেকে শুরু হল এই এক অত্যাচার। আমি মানা করে দিলে সে কথা বন্ধ করে দেয়।
বলে – তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না। তোমার সাথে কিসের ভালবাসা? কিসের সম্পর্ক?
আমি আবার দুর্বল হয়ে যাই। এভাবে পর পর তিনবার এই ঘটনার পর আমি বাবা মার সাথে আর চোখ মেলাতে পারছিলাম না। ছোট ভাই বোন গুলোর সামনে নিজেকে এত ছোট লাগতে শুরু করল!
সিদ্ধান্ত নিলাম – আর না। সে চলে গেলে যাবে। আমি অলরেডি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। আমার দরকার নেই এমন ভালবাসার।
এর মধ্যে আমার এসএসসির রেজাল্ট হল। রেজাল্ট যেরকম হবার কথা ঠিক তেমনই। জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন এ প্লাস। বাবা মা, টিচাররা ভীষণ খুশি হলেন। খুশি হল সে ও। সেই খুশিতে আবার একটা ন্যুড ছবি চাইলো সে।
আমি পরিষ্কার ইংরেজিতে জানিয়ে দিলাম – NO MEANS NO। তার রিয়েকশন কি হবে আমি আগেই জানতাম। সে যথারীতি কথা বলা বন্ধ করে দিল।
আমি ভীষণ কষ্ট পেতাম তবু তাকে নক দিতাম না। তারপর হঠাৎ একদিন দেখি ফেসবুকেই সে আর নেই।
জীবনের প্রথম প্রেমেই ছ্যাকা। কাউকেই বলি নি সেই কথা তখন পর্যন্ত । এমনকি এত বড় ঘটনা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড টিনার সাথেও শেয়ার করিনি। ভেবেছিলাম রেজাল্টের পরেই বলব। কিন্তু তার আর দরকার হল না। সিনেমা শুরুর আগেই THE END হয়ে গেল।
হৃদয় ভঙ্গের এই ব্যাথা সহ্য করা কিছুদিন খুব কঠিন মনে হলেও আমি একসময় কলেজ , ক্লাস, জীবনের নতুন আরেক অধ্যায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
কখনো কখনো রাতে ঘুমানোর সময় নিজেকে ভীষণ হেরে যাওয়া মনে হত তবু একটা ব্যাড একপেরিয়েন্স ভেবে ভুলে যাবার চেষ্টা করতাম।
আমি তো বুঝিই নি আসল ঘটনার কেবল তখনই শুরু হয়েছে । একদিন এনোনিমাস একটা আইডি থেকে মেসেজ এল। মেসেজ ওপেন করার সাথে সাথে আমার পায়ের নিচের পৃথিবী দুলে উঠল।
আমার ছবি, মানে আমার ন্যুড ছবি ইনবক্সে পাঠিয়েছে কেউ। বলা বাহুল্য কেউ মানে সেই।
ছবিটা দেখা মাত্র আমার মাথায় প্রথম যে কথা এলো সেটা হল ছবিতে আমার মুখ দেখা যায় না সত্য, কিন্তু আমার রুমের প্রতিটা জিনিস চেনা যায়। অথচ পাঠানোর সময় আমি এগুলো খেয়ালই করি নাই।
আমার বিছানার চাদর, পড়ার টেবিল, ওয়্যারড্রোব সব। ও আল্লাহ মা দেখা মাত্র চিনে ফেলবে ।
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলাম – কি চাও ?
সে লিখল – ছবি ।
– না
– তাহলে আমি এটা ভাইরাল করে দিব।
– ছবিতে আমার মুখ নেই। কোন প্রমাণ নেই যে আমি।
– তোমার মেসেঞ্জার থেকে পাঠান হয়েছে এটা প্রমাণ করতে আমার সময় লাগবে না।
আমি কেঁদে ফেললাম হাউ মাউ করে। লিখলাম – কেন এমন করছ? আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করি না।
– এইসব ডায়লগ বাজি বন্ধ কর। ছবি দাও নইলে ভাইরাল হবার জন্য প্রস্তুত হউ ।
আমি কথা না বাড়িয়ে তাকে ব্লক করে দিলাম। আর সেদিন থেকেই আমার জীবন থেকেও সমস্ত সুখ ব্লক হয়ে গেল। আমার সমস্ত অস্তিত্ব গ্রাস করে নিলো এক কুৎসিত ভয়। সারাদিন কয়েকবার বমি হল আমার ।
জীবনের সমস্ত স্বাভাবিকতা,উচ্ছলতা ,আনন্দ সব অফিসিয়ালি শেষ হল সেদিন ।
আমি জানতাম সে আবার যোগাযোগ করবে অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য নামে। আমি আমার ফেসবুক ডিএকটিভ করে দিলাম। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম।
কিন্তু ভয় আমার পিছু ছাড়ল না। বাবা মা কোন কারণে ডাকলেও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। মনে হত উনারা জেনে ফেলেছেন সব।
ভয় পুষতে পুষতে অসুস্থ হতে শুরু করলাম। খেতে পারি না ,ঘুমাতে পারি না ,বমি ,পেট খারাপ, গ্যাস্টিক এসিডিটি, পৃথিবীর যাবতীয় সাইকোসম্যাটিক অসুখের গোডাউন হয়ে গেলাম।
এরকম খুনখুনে অসুখে পড়ালেখাও শিকেয় উঠল।
এর মাঝেই আমি কয়েকবার সাহস করে ফেসবুক অ্য কটিভ করেছি। ভেবেছি সে আর মেসেজ দেবে না।
কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
আমি ভয়ে আশঙ্কায় প্রতি মুহূর্তে মরতে থাকলাম। আর তারই শেষ পরিণতি আমার এইএসসির রেজাল্ট ।
আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এভাবে আর চলতে দেয়া যায়না। এই ঘটনা শেষ করতে হবে চিরতরে। আজকে রাতেই। এই জীবন বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আমি টায়ার্ড হয়ে গেছি।
আমি আমার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ওয়্যারড্রোব থেকে সবচেয়ে শক্ত ওড়নাটা বের করে ফ্যান এর সাথে বাঁধলাম। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে নিজের গলার সাথে যখন ওড়নাটা পেঁচাচ্ছিলাম, তখন মা বাবা আর ভাই বোন দুটোর কথা খুব মনে পড়ছিল। তবুও সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম পায়ের নিচের চেয়ারটাকে।
ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকা আমার লাশ জানলো না, পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে বাবা আমার মা কে বলছেন – ঈশির মা, আমাদের মেয়েটা অন্য কোন সমস্যায় আছে। নইলে মেয়ের এইরকম রেজাল্ট হত না ।এমনিতেও সে সারদিন মন মরা থাকে, কারো সাথে মিশে না। মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে বুঝলা?
কালকে সকালে আমি নিজে মেয়ের সাথে কথা বলবো। তাকে বোঝাতে হবে যে পৃথিবীতে তাঁর থেকে মূল্যবান আমাদের কাছে কিছু নাই। তাঁর ভাল থাকাই সব। এই বয়সী বাচ্চাদের কোন বিশ্বাস নাই ।
বলা যায়না, কখন আবার কোন কারণে আত্মহত্যা করে ফেলে!
