কম্বল || রম্য গল্প
বিশাল অনুষ্ঠান হচ্ছে, বাড়ি ভর্তি লোকজন। গৃহকর্তা সবার সামনে এসে দাড়ালেন। উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনাদের মধ্যে ছেলেপক্ষ কে কে হাত তুলুন।’
কিছুসংখ্যক লোক হাত তুললো।
– এবারে মেয়েপক্ষ আছেন কারা কারা হাত তুলুন।
আরো কিছু লোক হাত তুললো।
গৃহকর্তা কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘আপনাদের মাঝে ছেলেপক্ষ এবং মেয়েপক্ষ বাদে যারা আছেন তারা থাকুন আর এই দু’পক্ষের লোক দয়া করে চলে যান। কারণ আজ আমার ছেলের সুন্নতে খাৎনা।’
_________
আমার অবস্থাও হয়েছে উপরের গল্পটার মতন। কমিউনিটি সেন্টারে এসে উপস্থিত কিন্তু বুঝতে পারতেছিনা এখানে কিসের অনুষ্ঠান। কারো বিয়ে, নাকি মুসলমানি? এমনকি চল্লিশা হওয়াও বিচিত্র না। তাই বলে আবার ভাইবেন না যে আমি দাওয়াত ছাড়া খাইতে আসছি। আচ্ছা খুলেই বলি।
ঘটনার শুরু আজকে সাতসকালে। আব্বু আমাকে কোনোমতে ঘুম থেকে তুলে হাতে এক হাজার টাকার তিনটা নোট ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘বিশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে শ্রাবণী কমিউনিটি সেন্টারে চলে যা। কুইক!’
আমি যথেষ্ট বিরক্ত হলাম। আজকাল কি লোকে লাঞ্চের বদলে ব্রেকফাস্টের দাওয়াত দেয়া শুরু করলো নাকি? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবশ্য ভুল ভাঙলো। সেখানে প্রায় বারোটা বাজে।
__________
আমি বিশ মিনিটের জায়গায় দশ মিনিটে রেডি হয়ে রওনা দিলাম। বেশি দেরি হলে আবার রোস্ট, রেজালা শর্ট পরতে পারে। আজকাল লোকজন কোনো অনুষ্ঠানে আসেই শুধুমাত্র খাওয়ার কথা চিন্তা করে। বড়ই আফসোসের বিষয়!
__________
কমিউনিটি সেন্টারে পৌছে দেখি লোকে লোকারণ্য। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার কোনো আয়োজন নেই। আমি মনে হয় বেশি তাড়াহুড়া করে সময়ের অনেক আগেই চলে এসেছি। খাবার দিতে দেরি হবে।
একটা ফাকা চেয়ার দেখে চুপচাপ বসে ফেসবুকিং শুরু করলাম; এমন সময় দেখি এক আঙ্কেল আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। উনি আমাকে না চিনলেও আমি উনাকে খুব ভালো করে চিনি। উনার উপর আমার যথেষ্ট রাগও আছে। রাগের কারন আংকেলের সুন্দরী সুন্দরী তিনটা মেয়ে, কিন্তু সবাই আমার চাইতে বয়সে বড়। এজন্যই এলাকার বড় ভায়েরা উনাকে ভীষণ সম্মানও করে। তাতে আমার কি? আমি চোখমুখ শক্ত করে ফেসবুক চালাতে লাগলাম।
__________
আংকেল আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ, তোমাদের মতো ইয়াং ছেলেদের এখানে দেখে খুব ভালো লাগছে।’
আমি মনে মনে বললাম, ‘কেন আপনার মেয়েদের জন্য জামাই খুজতেছেন নাকি?’
কিন্তু মুখে কিছু না বলে উদাস চোখে অদুরে দাড়ানো এক সুন্দরী মেয়েকে দেখতে লাগলাম। পেটে খিদে থাকলেই আমি আবার ক্রাশ খাই!
আঙ্কেল ইতস্তত করে বললেন, ‘কিছু মনে কইরো না, তুমি আমার ছেলের মতো। তোমাকে তুমি করেই বললাম।’
আমি আবারো মনে মনে ভাবলাম, ‘আর দুইটা বছর আগে জন্ম নিলে আপনার জামাই এর মতোও হতে পারতাম। বড়ই আফসোস!’
তবে এবারো বাস্তবে কিছু না বলে উঠে চলে আসলাম।
__________
আমি জানি এই আঙ্কেলের কোনো ছেলে নেই; আর আমারো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। আমি এতোক্ষণ ধরে দেখা মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম, ‘হাই, তুমি তো আমার জিএফের মতো। আমি তোমাকে তুমি করে বলি?’
গল্প উপন্যাসে এই মুহুর্তে ঠাশ করে একটা চড়ের কথা লেখা থাকে। আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছি। মেয়েটার হাত বেশ সফট হওয়ার কথা!
কিন্তু মেয়েটা আমাকে অবাক করে দিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো।
– ‘আরে তুমি সোহাইল না? এখনো দেখি রসিক আছো আগের মতোই। আমারে চিনছো? আমি সাদিয়া।’
__________
অনেক চিন্তা- ভাবনা করে দেখলাম সাদিয়া নামে আমি বাংলাদেশে মাত্র দু’জনকে চিনি। দু’জনই নাটক করে। একজন জাহিদ হাসানের বউ, ‘সাদিয়া ইসলাম মৌ’ আর আরেকজন দেশের যুবসমাজের একটা বড় অংশের কল্পনার বউ, ‘সাদিয়া জাহান প্রভা’।
ও হ্যা আরেকজনকেও চিনি। জুনায়েদ- সাদিয়া।
__________
– আরে আমি সাদিয়া হক। তোমার সাথে একই ক্লাসে পড়তাম।
– কিন্তু আমি তো সরকারি বয়েজ স্কুলে পড়েছি।তারমানে? ওয়েট, ওয়েট, তুমি সেক্স চেঞ্জ করে পরে ছেলে থেকে মেয়ে হওনি তো?
– ধুররর, সবসময় ফাজলামি কিন্তু ভাল্লাগেনা। আমরা পিটিআইতে একসাথে প্রাইমারি পড়েছি।
– ওহ তুমি সেই পুচকে সাদিয়া! আমি শেষমেশ চিনতে পারলাম। কত্ত বড় হয়ে গেছ। ইউ আর আ কমপ্লেন গার্ল।
– হি হি হি, সাদিয়া সুন্দর করে হাসলো। হাসলে ওকে অনেকটা আমার কল্পনার গার্লফ্রেন্ডের মতন দেখায়, আমি নোটিশ করলাম।
– তো? আমি আলাপ জমানোর জন্য প্রশ্ন করলাম। তুমি ছেলেপক্ষ না মেয়েপক্ষ?
সাদিয়া আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে জোরে জোরে হাসা শুরু করলো।
আমি হাসির কারন বুঝতে পারলাম না। একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘ইয়ে মানে খুব খিদে পেয়েছে। খাবার কখন দেবে?’
সাদিয়া হাসি থামিয়ে একটু কপট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘উফস সোহাইল, তোমার মজা করার স্বভাব আর গেলোনা। যাও ঐ ঘরে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসো।’
আমি মনে মনে ভাবলাম এখানে মেবি খাওয়ার আগেই সেলামী জমা দেয়ার সিস্টেম। আজকাল নতুন নতুন কতো কিছুই যে হচ্ছে।
__________
তবে পাশের রুমে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার এতোক্ষন অবাক হওয়ার সব লিমিট ক্রস করলো।
রুমে চেয়ার টেবিল নিয়ে কয়েকজন বসে আছে আর তাদের পেছনে বিশাল এক ব্যানার –
___শীতার্তদের সহযোগীতায় তহবিল গঠন প্রকল্প___
…. আমি সাদিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে সেখানে উত্তরবঙ্গের জনগণের কম্বল কিনে দেয়ার জন্য তিন হাজার টাকা ডোনেট করে দিলাম।
__________
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলার মাঝে আমি ওকে সিস্টেম করে জানিয়ে দিলাম আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেছি এবং এখনো সিঙ্গেল আছি। জীবনের স্বপ্ন শুধুমাত্র একটা মেয়েকেই সারাজীবন ভালোবাসবো।
__________
সাদিয়া ইমপ্রেস হয়ে গেল। তবে সেটা আমার ওয়ান গার্ল থিওরিতে না। আমি যে স্টুডেন্ট হয়েও এতোগুলো টাকা মানুষের সাহায্যে ডোনেট করলাম, এজন্য।
– বুঝলা সোহাইল, মানুষ যে আজকাল ফেসবুক স্ট্যাটাসের বাইরেও মানুষের পাশে দাঁড়ায় সেটা এখানে এসে তোমাদের না দেখলে বুঝতামই না।
আমি মুখে হাজি মুহাম্মাদ মহসিনের যুবক বয়সের হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালালাম।
__________
তারপর হঠ্যাৎ করেই লক্ষ্য করলাম রোস্ট, রেজালা না খেতে পারার জন্য আমার একফোঁটা আফসোসও হচ্ছে না। উলটা বরং কারো জন্য কিছু করতে পারার একটা অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে! যে অনুভূতির সাথে পৃথিবীর আর কোনো ভালোলাগার মিল নেই। এটা যেন অনেকটা ঠিক স্বর্গীয়।
__________
আমি অনেক্ষন চুপ করে থেকে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, `শুনো সাদিয়া, জীবনে এই প্রথমবারের মতো আমি সিরিয়াস। দেখ, তুমি নিশ্চয় বাড়িতে একা একটা কম্বল ইউজ করো। আবার আমিও একাই পুরো একটা কম্বল ইউজ করি। তো ধরো সামনের কোনো এক শীতে যদি আমরা দু’জন একটা কম্বল ইউজ করতে পারি; তাইলে কিন্তু আরেকটা কম্বল খুব সহজেই কোনো দরিদ্র শীতার্তকে দান করে দেওয়া সম্ভব। কি বলো? ঠিক বলেছি না?’
__________
এখন কি হবে? ঠাস করে একটা চড়ের শব্দ? নাকি ও লাজুক হাসি দিয়ে বলবে, ধুরর, এত্তো মজা করো ক্যান? নাকি অন্যকিছু বলবে!
__________
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। জীবনের কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে অপেক্ষা করতে ভালোই লাগে!
__________
